

বাংলাদেশে ‘স্মার্ট’ শব্দটি এখন আর শুধু ফোন বা টিভির গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নেই। সরকারিভাবে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ ঘোষণার পর শহর ব্যবস্থাপনাতেও যুক্ত হয়েছে নতুন শব্দ, স্মার্ট সিটি। প্রশ্ন হলো, এই স্মার্টনেস কি কেবল প্রযুক্তির প্রদর্শনী, নাকি নাগরিক জীবনে বাস্তব পরিবর্তন?
ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী কিংবা খুলনা, প্রতিটি বড় শহরেই এখন সিসিটিভি ক্যামেরা, ডিজিটাল ট্রাফিক সিগন্যাল, অ্যাপভিত্তিক সেবা কিংবা স্মার্ট কার্ডের ব্যবহার দেখা যায়। কিন্তু স্মার্ট সিটি কি শুধু এসব প্রযুক্তিগত সংযোজনের নাম?
স্মার্ট সিটি বলতে আসলে কী বোঝায়
বিশ্বজুড়ে স্মার্ট সিটির মূল ধারণা দাঁড়িয়ে আছে মানুষকেন্দ্রিক প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনার ওপর। অর্থাৎ-
নাগরিক সেবা সহজ হবে
সময়, খরচ ও ভোগান্তি কমবে
সিদ্ধান্ত হবে ডেটাভিত্তিক
শহর হবে নিরাপদ, টেকসই ও বাসযোগ্য
শুধু ক্যামেরা বসানো বা অ্যাপ চালু করলেই কোনো শহর স্মার্ট হয়ে যায় না, এই জায়গাতেই বাংলাদেশের বাস্তবতা প্রশ্নের মুখে পড়ে।
বাংলাদেশে স্মার্ট সিটির চর্চা: অগ্রগতি না প্রদর্শনী?
ঢাকায় ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় সিসিটিভি, ই-চালান ব্যবস্থা কিংবা স্মার্ট সিগন্যাল যুক্ত হয়েছে। কিছু সেবায় অনলাইন আবেদন ও ডিজিটাল পেমেন্ট চালু হয়েছে। কিন্তু মাঠপর্যায়ে নাগরিক অভিজ্ঞতা খুব একটা বদলায়নি।
আজও-
ট্রাফিক জ্যাম অনিয়ন্ত্রিত
ফুটপাত দখলমুক্ত নয়
বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এলোমেলো
জলাবদ্ধতা ও নাগরিক নিরাপত্তা বড় সমস্যা
প্রযুক্তি আছে, কিন্তু সমন্বিত ব্যবস্থাপনা নেই, এটাই সবচেয়ে বড় দুর্বলতা।
সিসিটিভি বনাম নাগরিক নিরাপত্তা
বাংলাদেশের শহরগুলোতে হাজার হাজার সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। অপরাধ তদন্তে কিছু ক্ষেত্রে এগুলো সহায়ক হলেও, নাগরিকদের প্রশ্ন- এই নজরদারি কি সত্যিই নিরাপত্তা বাড়াচ্ছে, নাকি শুধু নজরদারিই বাড়ছে?
স্মার্ট সিটির মূল লক্ষ্য যেখানে অপরাধ প্রতিরোধ, সেখানে আমাদের শহরে প্রযুক্তি অনেক সময় প্রতিক্রিয়াশীল, প্রতিরোধমূলক নয়। অপরাধ ঘটার পর ফুটেজ দেখা হয়, কিন্তু আগাম সতর্কতা বা নাগরিক সুরক্ষার কাঠামো এখনও দুর্বল।
ডেটা আছে, কিন্তু সিদ্ধান্ত কি ডেটাভিত্তিক?
স্মার্ট সিটির প্রাণ হলো ডেটা। ট্রাফিক, পানি, বিদ্যুৎ, বর্জ্য, সবকিছু ডেটার মাধ্যমে পরিচালিত হয় উন্নত শহরে। বাংলাদেশে ডেটা সংগ্রহ হচ্ছে, কিন্তু সেই ডেটা বিশ্লেষণ করে বাস্তব নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার সংস্কৃতি এখনও গড়ে ওঠেনি।
ফলে প্রযুক্তি থাকলেও শহর পরিচালনায় রয়ে গেছে পুরোনো আমলাতান্ত্রিক ধারা।
নাগরিক কি স্মার্ট সিটির অংশ?
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন এখানেই। স্মার্ট সিটি যদি নাগরিককে বাদ দিয়ে তৈরি হয়, তাহলে তা কখনোই টেকসই হয় না। বাংলাদেশের স্মার্ট সিটি উদ্যোগে নাগরিক অংশগ্রহণ এখনও সীমিত।
অ্যাপ আছে, কিন্তু সবাই ব্যবহার করতে পারে না।
ডিজিটাল সেবা আছে, কিন্তু ডিজিটাল সাক্ষরতা সমান নয়।
ফলে স্মার্ট সিটি অনেক সময় নির্বাচিত শ্রেণির জন্য স্মার্ট, সবার জন্য নয়।
তাহলে বাংলাদেশ কতটা স্মার্ট পথে?
বাংলাদেশ স্মার্ট সিটির পথে হাঁটছে, এ কথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কিন্তু সেই পথ এখনও অসম্পূর্ণ, খণ্ডিত এবং প্রযুক্তিকেন্দ্রিক, মানুষকেন্দ্রিক নয়।
স্মার্ট সিটি তখনই বাস্তব হবে, যখন-
প্রযুক্তি সিদ্ধান্তের হাতিয়ার হবে, প্রদর্শনী নয়
নাগরিক মতামত ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে
সেবা শুধু ডিজিটাল নয়, ব্যবহারবান্ধব হবে।
শেষ কথা
বাংলাদেশের শহরগুলো এখন ‘স্মার্ট হওয়ার প্রক্রিয়ায়’ আছে, কিন্তু এখনও ‘স্মার্ট হয়ে ওঠেনি’। সেলফ, সিসিটিভি আর অ্যাপ, এই তিনে শহর স্মার্ট হয় না। স্মার্ট হয় তখনই, যখন নাগরিক জীবন বাস্তবে সহজ, নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ হয়ে ওঠে।
প্রযুক্তি পথ দেখাতে পারে, কিন্তু শহরকে সত্যিকারের স্মার্ট করে তোলে মানুষের অভিজ্ঞতা।