

জলবায়ু পরিবর্তন এখন আর ভবিষ্যতের আশঙ্কা নয়, এটি বর্তমানের কঠিন বাস্তবতা। ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও ঘনঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মানবসভ্যতার অস্তিত্বকেই প্রশ্নের মুখে ফেলছে। এই সংকটের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে প্রযুক্তি, যাকে একসময় পরিবেশ ধ্বংসের অন্যতম কারণ হিসেবে দায়ী করা হতো।
আজ সেই প্রযুক্তিকেই দেখা হচ্ছে সমাধানের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে। এই প্রেক্ষাপটেই সামনে এসেছে সবুজ প্রযুক্তি (Green Technology)।
সবুজ প্রযুক্তি কী?
সবুজ প্রযুক্তি বলতে এমন সব প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনকে বোঝানো হয়, যা পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব কমায়, প্রাকৃতিক সম্পদের টেকসই ব্যবহার নিশ্চিত করে এবং কার্বন নিঃসরণ হ্রাসে ভূমিকা রাখে। এর লক্ষ্য কেবল উন্নয়ন নয়, বরং টেকসই উন্নয়ন। যেখানে অর্থনীতি, পরিবেশ ও মানবজীবনের মধ্যে ভারসাম্য বজায় থাকে।
জ্বালানি খাতে সবুজ বিপ্লব
সবুজ প্রযুক্তির সবচেয়ে দৃশ্যমান প্রয়োগ ঘটেছে জ্বালানি খাতে। কয়লা ও তেলের মতো জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প হিসেবে সৌর, বায়ু ও জলবিদ্যুৎ দ্রুত জনপ্রিয় হচ্ছে। সৌর প্যানেলের দাম কমে যাওয়ায় গ্রামাঞ্চল থেকে শুরু করে শিল্পকারখানা পর্যন্ত নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ছে।
বিশ্বজুড়ে অনেক দেশ এখন নেট-জিরো কার্বন নিঃসরণ লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে, যেখানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদন নয়, শক্তি সংরক্ষণে উন্নত ব্যাটারি প্রযুক্তিও এই রূপান্তরকে আরও কার্যকর করছে।
স্মার্ট প্রযুক্তি ও শক্তির দক্ষতা
সবুজ প্রযুক্তির আরেকটি বড় দিক হলো শক্তির দক্ষ ব্যবহার। স্মার্ট গ্রিড, স্মার্ট মিটার ও এআই-ভিত্তিক শক্তি ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থার মাধ্যমে বিদ্যুৎ অপচয় কমানো সম্ভব হচ্ছে। অফিস ভবন থেকে শুরু করে আবাসিক এলাকায় স্মার্ট লাইটিং ও স্বয়ংক্রিয় তাপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কার্বন নিঃসরণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমাচ্ছে।
শিল্পখাতেও দেখা যাচ্ছে পরিবর্তন। আধুনিক মেশিনারি ও অটোমেশন ব্যবহারের মাধ্যমে একই উৎপাদনে কম শক্তি খরচ করা সম্ভব হচ্ছে, যা পরিবেশ ও অর্থনীতি, উভয়ের জন্যই ইতিবাচক।
কৃষিতে প্রযুক্তি ও পরিবেশ সুরক্ষা
জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগীদের একটি কৃষি খাত। এখানেও সবুজ প্রযুক্তি আশার আলো দেখাচ্ছে। প্রিসিশন এগ্রিকালচার, সেন্সরভিত্তিক সেচব্যবস্থা ও ড্রোন প্রযুক্তি কৃষকদের জমি ও পানির ব্যবহার আরও দক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করছে।
ফসলের রোগ শনাক্তকরণ, আবহাওয়া পূর্বাভাস ও মাটির গুণাগুণ বিশ্লেষণে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ায় উৎপাদন বাড়ছে, কমছে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার, যা পরিবেশের জন্য বড় স্বস্তি।
পরিবহন খাতে সবুজ রূপান্তর
পরিবহন খাত বিশ্বব্যাপী কার্বন নিঃসরণের অন্যতম প্রধান উৎস। এই খাতে সবুজ প্রযুক্তির অগ্রযাত্রা তাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বৈদ্যুতিক গাড়ি, হাইব্রিড যান ও হাইড্রোজেন চালিত পরিবহন ধীরে ধীরে প্রচলিত জ্বালানিনির্ভর যানবাহনের বিকল্প হয়ে উঠছে। একই সঙ্গে স্মার্ট ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম ও শেয়ারড ট্রান্সপোর্ট মডেল যানজট ও জ্বালানি অপচয় কমাতে সাহায্য করছে, যা শহুরে দূষণ হ্রাসে কার্যকর ভূমিকা রাখছে।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও সার্কুলার ইকোনমি
সবুজ প্রযুক্তির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। রিসাইক্লিং প্রযুক্তি, বর্জ্য থেকে জ্বালানি উৎপাদন এবং সার্কুলার ইকোনমি ধারণা পরিবেশবান্ধব ব্যবস্থাকে এগিয়ে নিচ্ছে।
প্লাস্টিক বর্জ্য পুনর্ব্যবহার, ইলেকট্রনিক বর্জ্য থেকে মূল্যবান ধাতু উদ্ধার, এসব প্রযুক্তি একদিকে দূষণ কমাচ্ছে, অন্যদিকে নতুন অর্থনৈতিক সম্ভাবনাও তৈরি করছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সবুজ প্রযুক্তি
বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি। তাই এখানে সবুজ প্রযুক্তির গুরুত্ব আরও বেশি। সৌর বিদ্যুৎ, বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট, জলবায়ু-সহনশীল অবকাঠামো ও আগাম দুর্যোগ সতর্কীকরণ ব্যবস্থায় প্রযুক্তির ব্যবহার ইতোমধ্যে ইতিবাচক ফল দেখাতে শুরু করেছে।
তবে চ্যালেঞ্জও কম নয়। বিনিয়োগ ঘাটতি, প্রযুক্তিগত দক্ষতার অভাব এবং দীর্ঘমেয়াদি নীতির দুর্বলতা এই খাতের অগ্রগতিকে ধীর করছে।
সামনে পথচলা
সবুজ প্রযুক্তি একা জলবায়ু সংকট সমাধান করতে পারবে না, তবে এটি হতে পারে সবচেয়ে কার্যকর সহায়ক শক্তি। এর জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় নীতি সহায়তা, বেসরকারি বিনিয়োগ এবং সর্বোপরি জনসচেতনতা।
জলবায়ু সংকটের বিরুদ্ধে লড়াই এখন আর শুধু পরিবেশবিদদের দায়িত্ব নয়। এটি প্রযুক্তিবিদ, নীতিনির্ধারক ও সাধারণ মানুষের সম্মিলিত চ্যালেঞ্জ। আর এই লড়াইয়ে সবুজ প্রযুক্তি হয়ে উঠতে পারে টিকে থাকার সবচেয়ে বড় ভরসা।