গল্পটা গুগলের সিনিয়র প্রডাক্ট ম্যানেজার চট্টগ্রামের মেয়ে শাম্মীর!

গুগলে ৯টা থেকে ৫টা পর্যন্ত অফিস টাইম। সপ্তাহে তিনদিন ব্রাঞ্চে এবং বাকি দুই দিন বাসায় বসে অফিস করা হয়। তবে সময়টা নির্ধারিত নয়। যার যার সুবিধামত যে কোন সময়ে কাজ করতে পারবে।
গল্পটা গুগলের সিনিয়র প্রডাক্ট ম্যানেজার চট্টগ্রামের মেয়ে শাম্মীর!

চট্টগ্রামের মেয়ে শাম্মী শাওকাত কুদ্দুস

প্রকাশিত

শাম্মী শাওকাত কুদ্দুস চট্টগ্রামের মেয়ে। পড়াশোনা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটি, হার্ভার্ড ও স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানে। বর্তমানে গুগলের 'সিনিয়র প্রডাক্ট ম্যানেজার' হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার সাফল্য ও সম্ভাবনার গল্প শুনেছেন আনিসুল ইসলাম নাঈম

বন্দরনগরী চট্টগ্রামেই আমার শৈশব ও বেড়ে উঠা। বাবা মা এবং এক বড় ভাই নিয়ে আমাদের পরিবার। বাবা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান এবং মা পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন। বাবা মা শিক্ষক হওয়াতে ছোট থেকেই পড়াশোনায় ডুবে থাকতাম। মায়ের কাছ থেকে সায়েন্স, ম্যাথের পাঠ শিখতাম। পড়াশোনার বাইরে তেমন কিছু করা হতো না। তাই শখের বসে এসএসসি বা 'ও' লেভেল পাসের পর কারাতে শিখতে শুরু করি। প্রায় তিনবছর কারাতে শিখে ব্ল্যাক বেল্ট অর্জন করি। এতে মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যও ভালো থাকতো। সেসময় কারাতে প্রতিযোগিতায় জেলা, বিভাগীয় এবং জাতীয় পুরস্কার জয় করেছি। 

এমআইটিতে স্নাতক

২০০৫ সালে এইচএসসি বা 'এ' লেভেল পাস করি। তখন  পরিবার ও শিক্ষকরা বিদেশে পড়াশোনার জন্য উৎসাহ দিতেন। তবে সঠিক গাইড করার মত কারো দেখা পাইনি। বাসায় কম্পিউটার ছিল। তখন ডায়ালগ মডেম ইন্টারনেট দিয়ে গুগলে ঢুঁ মারতাম। বিদেশে আবেদনের পদ্ধতি, কি কি কাগজপত্র প্রয়োজন—এসব খুঁটিনাটি জানার চেষ্টা করি। এরপর চট্টগ্রাম থেকে দেই স্যাট পরীক্ষা। সব কাগজপত্র গুছিয়ে আমেরিকাতে ১৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ্যাপ্লাই করি। সাথে কারাতের অর্জনগুলো বেঁধে দেই। দিনকয়েক বাদে ১২টি বিশ্ববিদ্যলায় থেকে স্কলারশিপ পাই! শেষমেষ এমআইটিকে বেছে নেই। তখন বয়স কম হলেও বাঁধা হতে দেয়নি। সাহস নিয়ে এমআইটিতে এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে মার্কিন মুল্লুকে পাড়ি জমাই। নতুন পরিবেশ শুরুতে বেগ পেতে হয়। তবে ক্যাম্পাস, পড়াশোনার পরিবেশ—অল্পতেই স্বাভাবিকতার দেখা পাই। এমআইটিতে বিকেলে চলত খেলাধুলা ও সহশিক্ষা কার্যক্রম। সেখানে কারাতে নয়, তায়কোয়ান্দো শিখতে শুরু করি। তখন তায়কোয়ান্দো টিমের সাথে অনেক কাপ জিতেছে। ২০১০ সালে এমআরটির পাঠ শেষ হয়। 

গুগল সম্পর্কে জানাশোনা 

এমআইটি'র ডিগ্রি শেষে গন্তব্য মাতৃভূমি। দেশে ওয়াটার হেলথ ইন্টারন্যাশনাল, জীয়ন এবং কয়েকটি সামাজিক ব্যবসায় প্রায় ৩ বছর কাজ করি। সেসময় অ্যাপ তৈরি, প্রযুক্তি এবং কিভাবে প্রডাক্ট তৈরি হয়—এসব বিষয়ের সাথে পরিচিত হয়। তখন ইচ্ছে জাগে এসব নিয়ে কাজের পরিধি বাড়ানোর। সেই চিন্তা থেকে আবার আমেরিকায় স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ পড়তে যাই। এবার সঙ্গী আমার ছোট মেয়ে। পাশাপাশি হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলে চলে পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের উপর মাস্টার্স ডিগ্রি। স্ট্যানফোর্ড থেকে গুগল ক্যাম্পাসের দূরত্ব ছিল ১৫ মিনিট। আমার স্ট্যানফোর্ডের সহপাঠীরা অনেকেই এমবিএ শুরু করার আগেই গুগলে জব করতেন। প্রফেসররা গুগল নিয়ে ক্লাসে কথা বলতেন। তখন থেকে মনের কোনে গুগলে চাকরির স্বপ্ন বুনি। ভাবতাম, সহপাঠীরা পারলে; আমি কেন না! নিজের উপর আত্মবিশ্বাসের পাল্লা ভারী হতে থাকে।

শাম্মী শাওকাত কুদ্দুস

যেভাবে গুগলে

গুগলে চাকরির পথটা কঠিন ছিল। স্ট্যানফোর্ডে এমবিএ'র সময় গুগলে ইন্টার্ণশিপে এ্যাপ্লাই করি। ফলাফলে রিজেক্ট লেটার আসে। দেশে চাকরির অভিজ্ঞতা গুগল আমলে নেয়নি। বাধ্য হয়ে আরেকটা কোম্পানিতে ইন্টার্ণশিপ করি। ফলে সিভিটা ভারী হয়। এমবিএ শেষের দিকে গুগলে কয়েকবার এ্যাপ্লাই করি। বার বার রিজেক্টের দেখা পাই। তবে এমবিএ'র সপ্তাহখানেক পরে বিজনেস স্ট্র্যাটেজি রোলে গুগলের ক্রোম টিমে ডাক পাই। তখন গুগলের সানিভেল ক্যালিফোর্নিয়া শাখায় চারটা ইন্টারভিউ হয়। সব গুলো ইন্টারভিউতে উতরে যাই। দিনকয়েক পর ২০১৮ সালের মাঝামাঝিতে অফার লেটার আসে। তখনকার অনুভূতিটা স্বপ্নের মত! ছোটবেলা থেকে ইন্টারনেট মানে বুঝতাম গুগলডটকম। সে কম্পানির একজন হবো, এটা অবিশ্বাস্য ছিল! বারবার ব্যর্থতার দেখা পেলেও হাল ছাড়িনি। এ যাত্রায় পরিবার যথেষ্ট সাপোর্ট দিয়েছেন। তখন গুগলের 'কাস্টমার ইনসাইটস ম্যানেজার' পদে জয়েন করি। এটি নন-ইঞ্জিনিয়ারিং পদবী। গুগলে যত বাংলাদেশি রয়েছে তার বেশিরভাগই ইঞ্জিনিয়ারিং পদের। অল্প কয়েকজন নন-ইঞ্জিনিয়ার। 

গুগলে কি কাজ 

প্রথম ১ বছর গুগল ক্রোম টিমে এবং বিগত ৫ বছর গুগল পেমেন্ট টিমে আছি। বর্তমানে 'সিনিয়ার প্রডাক্ট ম্যানেজার' হিসেবে ক্রোম টিমে কাজ করছি। পেমেন্ট টিম গুগলে টাকা আয়ের এবং ব্যয়ের হিসাব তদারকি করে থাকে। প্রতি বছর ৩০০ বিলিয়ন ডলারের উপর পেমেন্ট টিম দেখাশুনা করে থাকে। এরমধ্যে ইউজাররা গুগল থেকে এডস, ক্লাউড স্পেস ও বিভিন্ন প্রডাক্ট কিনে। এজন্য তারা পে করে থাকেন। এসব প্রসেসিং আমাদের টিম করে। আবার ইউটিউব ও প্লে স্টোরে যারা ডেভেলপার আছে তাদের টাকা দিতে হয়। ইউটিউবে বিজ্ঞাপনের কিছু ডলার গুগল এবং বাকি ডলার ইউটিউবার পান। প্লে স্টোরে কিছু এ্যাপ ব্যবহারে ডলার পে করতে হয়। ঐ টাকা তখন গুগলে পে করলে, ডেভেলপাররা সেটা পান। এখানে ট্যাক্সসহ বিভিন্ন বিষয় পেমেন্ট টিমকে দেখতে হয়। ডেভেলপারদের বিভিন্ন প্রডাক্ট; প্রডাক্ট ম্যানেজরা ম্যানেজ করে। আমাদের টিম গুগলের ১০০ শ‘র উপর প্রডাক্টের সাপোর্ট বা মনিটাইজ করে থাকেন। এ ছাড়া ইউটিউব ও প্লে স্টোরের মতো কিছু পুরাতন প্রডাক্টে চোখ রাখতে হয়। গুগলে কিছু টিম প্রডাক্ট ডিজাইন করেন এবং কিছু টিম প্রডাক্ট মার্কেটে প্রকাশ করেন। আরেকটা টিম মার্কেটে প্রকাশের পর ইউজারের বিভিন্ন সমস্যা বা ফিডব্যাকের উপর কাজ করেন। গুগলে যেকোন প্রডাক্ট—২০০ শ'র বেশি দেশ, নানা ধরনের ভাষায় এবং সব ব্যবহারকারীদের মাথায় রেখে প্রকাশ করা হয়। এজন্য প্রডাক্ট ডিজাইনে অনেক চিন্তাভাবনা মাথায় রাখতে হয়। নতুন প্রডাক্ট প্রকাশের আগে লিডারশীপকে ম্যানেজ করতে হয়। এজন্য ইজ্ঞিনিয়ার সংখ্যা, সময় এবং প্রডাক্ট ডিজাইনে গুগল এবং ইউজারদের কি উপকারে আসবে— এধরনের বিষয়গুলো বুঝাতে হয়। তারা রাজি হলে প্রডাক্টের জন্য ইঞ্জিনিয়ার, ডিজাইনার এবং একটি টিম দেওয়া হবে। সর্বোপরি প্রডাক্টে নানা ধরনের ফিচারে সজ্জিত করি। এ ছাড়া গুগলে সবাই অনেক ট্যালেন্টেড মানুষ। এতবছর কাজ করলেও কখনো বিরক্তির ভাব আসেনি।

ইচ্ছেমত অফিস

গুগলে ৯টা থেকে ৫টা পর্যন্ত অফিস টাইম। সপ্তাহে তিনদিন ব্রাঞ্চে এবং বাকি দুই দিন বাসায় বসে অফিস করা হয়। তবে সময়টা নির্ধারিত নয়। যার যার সুবিধামত যে কোন সময়ে কাজ করতে পারবে। গুগল অফিসে সব বেলার খাবারের আয়োজন ফ্রি থাকে। এ ছাড়া জিম, ইয়োগা এবং বিভিন্ন ক্লাবে অংশগ্রহণের সুযোগ রয়েছে। পাশাপাশি গুগলে বছরের ১ মাস যেকোন দেশ বা জায়গা থেকে কাজ করার সুযোগ দেওয়া হয়। 

শাম্মী শাওকাত কুদ্দুস

গুগলে ডাক পেতে 

গুগলে প্রডাক্ট ম্যানেজার পদে দেশ থেকে সরাসরি নিয়োগ করে না। তবে ইঞ্জিনিয়ারিং পদের জন্য দেশের ব্যাচেলর শিক্ষার্থীদের নেওয়া হয়। নন-ইঞ্জিনিয়ারিং পদের জন্য বিদেশে একটা ব্যাচেলর বা মাস্টার্স ডিগ্রি করতে হয়। তখন সেদেশের গুগল অফিসে এ্যাপ্লাই করতে পারবে। এ্যাপ্লাইয়ের পর বাদ পরে গেলে হতাশ হবার কিছু নেই। আর ইন্টারভিউর ডাক আসলে তাড়াহুড়ো না করে প্র্যাকটিস করে ইন্টারভিউতে বসতে হবে। যে পদের জন্য এ্যাপ্লাই করা হবে সে অনুযায়ী সিভি তৈরি করে দিতে হবে। আমেরিকান স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী সিভি তৈরি করলে ভালো হবে। 

অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে চাই 

গুগলে ৬ বছর কেটে গেলেও প্রতিটা সময় উপভোগ করছি। তবে নতুন কম্পানি বা ভালো সুবিধা পেলে অবশ্যই সেখানে জয়েন করবো। দেশে কোন টেক প্রতিষ্ঠানে সুযোগ থাকলে অবশ্যই অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে চাই। 'বাংলাদেশ ইয়ুথ লিডারশীপ সেন্টার (বিওয়াইএলসি)' নামে একটি সংগঠন রয়েছে। এখানে  সময় দিয়ে থাকি ছাত্রদের  কারিয়ার গঠনমূলক প্রশিক্ষণে। পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন টেকনোলজি  প্রতিষ্ঠান ও চাকরিজীবীদের ওয়ার্কশপ করে থাকি। ভবিষ্যতে এই কর্মযজ্ঞ চালিয়ে যেতে চাই।

আরো পড়ুন

No stories found.
logo
The Metro TV | দ্য মেট্রো টিভি | The Metro TV Bangladesh | Bangla News Today | themetrotv.com |The Metro TV News
themetrotv.com