বাংলাদেশে ফ্রিল্যান্সিং: সম্ভাবনা, বিপত্তি ও বর্তমান বাস্তবতা

বাংলাদেশে ফ্রিল্যান্সিং: সম্ভাবনা, বিপত্তি ও বর্তমান বাস্তবতা

অনেকের জীবনে এই খাত বদলে দিয়েছিল কর্মসংস্থান, আয়ের ধরণ, এমনকি সামাজিক অবস্থানও
প্রকাশিত

একটা সময় ছিল-ল্যাপটপ আর ইন্টারনেট থাকলেই বিদেশি ক্লায়েন্টের কাজ পাওয়ার স্বপ্ন বাস্তব মনে হতো। বিশেষ করে ২০১৫ থেকে ২০২০-এই পাঁচ বছরে বাংলাদেশে অনলাইন ফ্রিল্যান্সিং যেন আলাদা এক অর্থনৈতিক আশার নাম হয়ে উঠেছিল। 

প্রশ্ন হলো- সেই সম্ভাবনা কি এখনও আছে, নাকি সময়ের সঙ্গে সেই জোয়ার ভাটায় পরিণত হয়েছে?

উত্থানের সময়কাল: কেন ২০১৫-২০ ছিল স্বর্ণকাল

এই সময়টাকে ফ্রিল্যান্সিংয়ের স্বর্ণকাল বলার কয়েকটি বাস্তব কারণ ছিল।

প্রথমত, বিশ্বজুড়ে আউটসোর্সিংয়ের চাহিদা দ্রুত বাড়ছিল। ছোট ও মাঝারি বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো কম খরচে দক্ষ কর্মী খুঁজছিল, আর বাংলাদেশ সেই চাহিদা পূরণে সামনে আসে।

দ্বিতীয়ত, দেশের ভেতরে ইন্টারনেট ও স্মার্টফোনের ব্যবহার বাড়তে শুরু করে। তরুণদের বড় একটি অংশ স্বল্প প্রশিক্ষণেই গ্রাফিক ডিজাইন, কনটেন্ট লেখা, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট বা ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের মতো কাজে যুক্ত হয়।

এই সময়েই বাংলাদেশ বিশ্ব অনলাইন ফ্রিল্যান্সিং বাজারে শীর্ষ সারির দেশ হিসেবে পরিচিতি পায়।

বর্তমান চিত্র: সুযোগ আছে, তবে আগের মতো সহজ নয়

২০২৫ সালের বাস্তবতায় এসে ফ্রিল্যান্সিংয়ের ছবি কিছুটা বদলেছে। সুযোগ পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়নি—বরং কাজের পরিসর আরও বেড়েছে। এখন শুধু ডিজাইন বা ডাটা এন্ট্রি নয়, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, ভিডিও কনটেন্ট, থ্রি-ডি অ্যানিমেশন, এমনকি এআই-ভিত্তিক কাজেও বাংলাদেশি ফ্রিল্যান্সারদের উপস্থিতি চোখে পড়ে।

তবে পার্থক্যটা হলো—এখন কাজ পাওয়া সহজ নয়, দক্ষ না হলে টিকে থাকা কঠিন। প্রতিযোগিতা বহুগুণ বেড়েছে। নতুনদের জন্য কাজ পাওয়ার পথ আগের মতো মসৃণ নেই।

বিপত্তি: যেখানে হোঁচট খাচ্ছে ফ্রিল্যান্সিং খাত

এই খাতের সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলোর একটি হলো আয়ের অনিশ্চয়তা। মাস শেষে নির্দিষ্ট বেতন নেই, কাজ থাকলে আয়—না থাকলে শূন্য।

এর সঙ্গে যোগ হয়েছে পেমেন্ট জটিলতা। বিদেশি আয়ের টাকা দেশে আনতে এখনো নানা বাধা ও কাটছাঁটের মুখে পড়তে হয়, যা অনেকের মোট আয়ের বড় অংশ খেয়ে ফেলে।

আরেকটি বড় বাস্তবতা হলো প্ল্যাটফর্ম-নির্ভরতা। অনলাইন মার্কেটপ্লেসের নিয়ম বদলালেই ফ্রিল্যান্সারের পুরো ক্যারিয়ার ঝুঁকিতে পড়ে যেতে পারে। কখনো অ্যাকাউন্ট বন্ধ, কখনো রেটিং কমে যাওয়া—এসবের বিরুদ্ধে তেমন কোনো শক্ত সুরক্ষা নেই।

সবচেয়ে স্পর্শকাতর বিষয়—ইন্টারনেটের স্থিতিশীলতা। কাজের মাঝখানে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলে শুধু সময় নয়, ক্লায়েন্টের আস্থাও হারানোর ঝুঁকি তৈরি হয়।

এআইয়ের ধাক্কা: ফ্রিল্যান্সিং বাজারে আয়, কাজ ও প্রতিযোগিতার নতুন হিসাব

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আসার পর অনলাইন ফ্রিল্যান্সিং বাজারে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এসেছে দামের কাঠামো ও কাজের চাহিদায়। আগে যেসব কাজের জন্য ঘন্টাভিত্তিক বা প্রজেক্টভিত্তিক ভালো আয় পাওয়া যেত—বেসিক কনটেন্ট লেখা, সাধারণ গ্রাফিক ডিজাইন, ডাটা প্রসেসিং—সেসব কাজে এখন ক্লায়েন্টের বাজেট কমছে। কারণ একই কাজ এআই টুল দিয়ে দ্রুত ও কম খরচে করিয়ে নেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে নিম্ন ও মাঝারি স্তরের ফ্রিল্যান্সারদের আয়ে।

অন্যদিকে, বাজার পুরোপুরি সংকুচিত হয়নি—বরং আয়ের স্তর বিভাজন আরও তীব্র হয়েছে। যারা এআই ব্যবহার করে কাজের মান, গতি ও স্কেল বাড়াতে পেরেছে, তাদের আয় বেড়েছে বা স্থিতিশীল রয়েছে। কিন্তু যারা এআই-বিরোধী অবস্থানে আছে বা শুধু পুরোনো স্কিলের ওপর নির্ভর করছে, তাদের জন্য কাজ পাওয়া কঠিন হয়ে উঠেছে। ফলে ফ্রিল্যান্সিং বাজার এখন আর সমতাভিত্তিক নয়; এটি হয়ে উঠছে দক্ষতা-নির্ভর ও প্রযুক্তি-নির্ভর।

অর্থনৈতিকভাবে এর মানে দাঁড়াচ্ছে—ফ্রিল্যান্সিং খাত থেকে মোট আয় কমেনি, কিন্তু সেই আয় কম সংখ্যক দক্ষ কর্মীর হাতে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। এআই তাই ফ্রিল্যান্সিংকে ধ্বংস করেনি, বরং একে রূপান্তর করেছে। এখন এই বাজারে টিকে থাকতে হলে শুধু শ্রম নয়, প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতাই হয়ে উঠেছে মূল পুঁজি।

সম্ভাবনার জায়গা: কোথায় এখনো শক্তি আছে

এই সব চ্যালেঞ্জের মাঝেও ফ্রিল্যান্সিং এখনো বাংলাদেশের জন্য বড় সম্ভাবনার খাত। কারণ দেশের তরুণ জনসংখ্যা, প্রযুক্তি শেখার আগ্রহ এবং বৈশ্বিক রিমোট কাজের সংস্কৃতি—এই তিনটি বিষয় একসঙ্গে কাজ করছে।

যাঁরা সাধারণ কাজের গণ্ডি পেরিয়ে বিশেষায়িত দক্ষতা গড়ে তুলতে পেরেছেন, তাঁদের আয় ও স্থায়িত্ব তুলনামূলকভাবে ভালো। অনেকেই এখন সরাসরি বিদেশি ক্লায়েন্টের সঙ্গে কাজ করছেন, ছোট টিম গড়ে তুলছেন।

ফ্রিল্যান্সিং কি ভবিষ্যতের নিরাপদ পেশা?

ফ্রিল্যান্সিং আর ‘সহজ আয়’-এর রাস্তা নেই। এটি এখন পূর্ণাঙ্গ একটি পেশা, যেখানে দক্ষতা, সময় ব্যবস্থাপনা ও ধৈর্য জরুরি।

যদি পেমেন্ট ব্যবস্থার উন্নতি হয়, ইন্টারনেট সেবা আরও নির্ভরযোগ্য হয় এবং দক্ষতা উন্নয়নে পরিকল্পিত বিনিয়োগ আসে—তাহলে এই খাত আগামী দিনেও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।

উপসংহার

২০১৫-২০ সময়ের সেই হঠাৎ জোয়ার হয়তো আর নেই। কিন্তু ফ্রিল্যান্সিং থেমে যায়নি—এটি পরিণত হয়েছে।

এখন এখানে টিকে থাকতে হলে শুধু ল্যাপটপ আর ইন্টারনেট যথেষ্ট নয়; দরকার বাস্তব দক্ষতা, পেশাদার মানসিকতা এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা।

সঠিক নীতিগত সহায়তা আর প্রস্তুতির মাধ্যমে অনলাইন ফ্রিল্যান্সিং এখনো বাংলাদেশের জন্য একটি টেকসই সম্ভাবনার নাম হতে পারে।

logo
The Metro TV | দ্য মেট্রো টিভি | The Metro TV Bangladesh | Bangla News Today | themetrotv.com |The Metro TV News
themetrotv.com