

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই, এই শব্দটি শুনলেই এখন অনেকের প্রথম প্রশ্ন একটাই: চাকরি থাকবে তো? কয়েক বছর আগেও এই উদ্বেগ ছিল ভবিষ্যৎকেন্দ্রিক, এখন তা বর্তমান বাস্তবতা। অফিস, কারখানা, অনলাইন কাজ—সবখানেই এআই ধীরে ধীরে ঢুকে পড়ছে। বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে নীরবে, কিন্তু গভীরভাবে। প্রশ্ন হলো, এআই কি সত্যিই চাকরি কেড়ে নিচ্ছে, নাকি আমাদের কাজ করার ধরনটাই বদলে দিচ্ছে?
যেখানে কাজ কমছে: সহজ ও রুটিন পেশার চাপ
এআইয়ের প্রথম আঘাত পড়েছে রুটিন ও পুনরাবৃত্তিমূলক কাজের ওপর। ডাটা এন্ট্রি, সাধারণ হিসাবরক্ষণ, বেসিক কনটেন্ট লেখা, গ্রাফিকের প্রাথমিক কাজ, এসব জায়গায় এখন সফটওয়্যার অনেক দ্রুত ও কম খরচে কাজ করতে পারছে।
এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে এন্ট্রি-লেভেল চাকরি ও নতুন ফ্রিল্যান্সারদের ওপর। আগে যেসব কাজ অভিজ্ঞতা অর্জনের প্রথম ধাপ হিসেবে কাজ করত, সেগুলোর সুযোগ এখন সংকুচিত হচ্ছে।
যেখানে কাজ বদলাচ্ছে: মানুষের ভূমিকা এখন ভিন্ন
তবে এআই পুরোপুরি মানুষকে বাদ দিচ্ছে, এমন নয়। বরং মানুষের ভূমিকা বদলে যাচ্ছে। আগে যেখানে একজন কর্মী নিজে সব করতেন, এখন সেখানে তিনি এআই টুল ব্যবহার করে কাজের তদারকি, মান যাচাই ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব নিচ্ছেন।
একজন কনটেন্ট রাইটার এখন শুধু লেখক নন, তিনি এডিটর ও কনটেন্ট স্ট্র্যাটেজিস্ট। একজন ডিজাইনার এখন শুধু ডিজাইন করেন না, তিনি ব্র্যান্ড ভাবনা ও ভিজ্যুয়াল দিকনির্দেশনা দেন। কাজের ধরন বদলেছে, কিন্তু মানুষের প্রয়োজন শেষ হয়ে যায়নি।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট: সুযোগ ও ঝুঁকি একসঙ্গে
বাংলাদেশের শ্রমবাজারে এই পরিবর্তন দ্বিমুখী প্রভাব ফেলছে। একদিকে তরুণদের বড় একটি অংশ দ্রুত নতুন প্রযুক্তি শিখে নিচ্ছে, অন্যদিকে দক্ষতা না বদলালে চাকরি হারানোর ঝুঁকিও বাড়ছে।
বিশেষ করে যেসব পেশা কম মজুরি ও কম দক্ষতার ওপর নির্ভরশীল, সেগুলো এআইয়ের চাপে সবচেয়ে নড়বড়ে হয়ে উঠছে। ফলে কর্মসংস্থানের প্রশ্ন এখন শুধু সংখ্যা নয়, গুণগত পরিবর্তনের বিষয়।
ফ্রিল্যান্সিং ও এআই: প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং ফিল্টার
অনলাইন ফ্রিল্যান্সিং বাজারে এআই একটি বড় ‘ফিল্টার’ হিসেবে কাজ করছে। সহজ কাজের দর কমেছে, কিন্তু বিশেষায়িত কাজের মূল্য বেড়েছে।
যাঁরা এআইকে কাজে লাগিয়ে কাজের গতি ও মান বাড়াতে পেরেছেন, তাঁদের আয় তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল। কিন্তু যাঁরা পুরোনো স্কিলেই আটকে আছেন, তাঁদের জন্য বাজার আগের চেয়ে কঠিন হয়ে উঠেছে। এআই এখানে চাকরি খাচ্ছে না, বরং অদক্ষতা বাদ দিচ্ছে।
নতুন কাজের জন্ম: যা আগে ছিল না
এআই শুধু কাজ কমায়নি, নতুন কাজও তৈরি করেছে। প্রম্পট ডিজাইন, এআই কনটেন্ট রিভিউ, ডেটা বিশ্লেষণ, এআই-সহায়ক সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, এই কাজগুলো কয়েক বছর আগেও পরিচিত ছিল না।
বাংলাদেশে এখন ধীরে ধীরে এই নতুন ধরনের পেশার চাহিদা তৈরি হচ্ছে, যদিও তা এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে।
চ্যালেঞ্জ: দক্ষতা রূপান্তরের চাপ
সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো স্কিল ট্রানজিশন। এআই-ভিত্তিক অর্থনীতিতে টিকে থাকতে হলে শুধু প্রযুক্তি জানা নয়, সমালোচনামূলক চিন্তা, সমস্যা সমাধান ও সৃজনশীলতা দরকার।
যদি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ এই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল না মেলাতে পারে, তাহলে এআই বৈষম্য বাড়াতে পারে—যেখানে কিছু মানুষ এগিয়ে যাবে, আর অনেকেই পিছিয়ে পড়বে।
ভবিষ্যৎ কী বলছে?
এআই চাকরি পুরোপুরি শেষ করে দেবে, এই ধারণা অতিরঞ্জিত। তবে এটা নিশ্চিত যে আগের মতো চাকরি আর থাকবে না। কাজের ধরন বদলাবে, দক্ষতার সংজ্ঞা বদলাবে, এমনকি ‘চাকরি’ শব্দটির মানেও বদলে যেতে পারে।
বাংলাদেশের জন্য প্রশ্নটা তাই এআই আসবে কি না, সেটা নয়। প্রশ্ন হলো, এই পরিবর্তনের জন্য আমরা কতটা প্রস্তুত।
উপসংহার
এআই চাকরি খাচ্ছে—এই ভয় আংশিক সত্য। কিন্তু পুরো সত্য নয়। এআই মূলত এমন কাজগুলোকে চাপে ফেলছে, যেগুলোতে মানুষের আলাদা মূল্য যোগ করার সুযোগ কম।
যদি দক্ষতা উন্নয়ন, প্রযুক্তি শিক্ষা ও নীতিগত প্রস্তুতি একসঙ্গে এগোয়, তাহলে এআই বাংলাদেশের শ্রমবাজারের জন্য হুমকি নয়, বরং নতুন সম্ভাবনার দরজা হতে পারে।